Shivbhumi BhimaShankar (শিবভূমি ভীমাশংকর)

This Article was Published in the Seventh Digital Edition of Anweshan

অন্বেষণ পত্রিকায় একটা লেখা জমা দিতে হবে’ গুরু ভাইরা আমাকে হঠাৎ একদিন এই অনুরোধ করে বসলেন। আমি তো খুব বিড়ম্বনায় পড়লাম, কারণ আমি কোন লেখক নই আবার কোন উচ্চতর ক্রিয়াবানও নই যে ক্রিয়া সম্বন্ধে কোন লেখা চটজলদি লিখে ফেলতে পারব। এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনের মধ্যে একটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো – ভ্রমণকাহিনী। তবে যেকোনো ভ্রমণকাহিনী তো দেওয়া যাবে না, তা যদি হয় কোন আধ্যাত্মিক স্থানের, যেখানে একাধারে পাওয়া যাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছোঁয়া, আবার সেই সঙ্গে এক সুগভীর ঐশ্বরিক অনুভূতি। স্মৃতির মণিকোঠায় এরকম অনেক ভ্রমণ বৃত্তান্ত ভেসে উঠলো। ঈশ্বরের কৃপায় আমি সুযোগ পেয়েছি অনেক দুর্গম মরু কান্তার পর্বত পেরিয়ে সেইসব নির্জন প্রকৃতির কোলে পৌঁছে যাওয়ার , যেখানে মন প্রান জুড়িয়ে গেছে কোমল প্রকৃতির স্পর্শে, আবার মন প্রাণের সমৃদ্ধি ঘটেছে এক চিরন্তন আনন্দের অনাবিল আধ্যাত্মিক চেতনার মধ্যে।

সময়টা ছিল ২০১২ সালের অক্টোবর মাস। দুর্গাপুজোর আর বেশি দেরি নেই; ভাবলাম, এই বছর কি পুজোর সময় কোথাও ভ্রমণে যাওয়া যাবে না? যেখানে পাওয়া যাবে একটু পার্বত্য ভূমির ছোঁয়া, একটু সবুজের স্পর্শ, একটু নির্জনতা আর তার সঙ্গে যদি সেটা কোন শিবভূমি হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। এরকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনের মধ্যে ভেসে উঠলো একটি নাম-ভীমাশংকর। জায়গাটি মহারাষ্ট্রের এক প্রসিদ্ধ শিবভূমি এবং দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম বলে বিশ্বাস করেন আমাদের দেশের ভক্ত মানুষজন। ভ্রমণসঙ্গী ও ইন্টারনেটের সাহায্যে খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিলাম। পুনা থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে সহ্যাদ্রি পর্বতের উপর ভীমাশংকর মন্দিরের অবস্থান।

দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর রাতে আমরা তিন বন্ধু হাওড়া থেকে আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসে করে রওনা দিলাম পুনার উদ্দেশ্যে। প্রায় ৩৬ ঘন্টা ট্রেন জার্নির পর সকাল এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম প্রায় ১৮৫০ কিলোমিটার দূরের পুনা স্টেশন। স্টেশনে নেমে একটু প্রাতরাশ সেরে অটো করে চলে এলাম শিবাজি নগর বাস টার্মিনাল। সেখানে এসে প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমরা মহারাষ্ট্র সরকারের ভীমাশংকরগামী বাসে ওঠার সুযোগ পেলাম। শুনলাম প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর ভীমাশংকর যাবার বাস পাওয়া যায়। সাধারণত যাত্রীরা একই দিনে সকাল বেলায় পুনা থেকে বেরিয়ে ভীমাশংকর দর্শন করে আবার পুনা ফিরে আসেন, কিন্তু আমাদের অন্তত একটি সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার ভীষণ ইচ্ছা ছিল। তাই আমাদের ফেরার তাড়া নেই।

লাল রঙের সরকারি বাস আমাদের নিয়ে টার্মিনাস থেকে বেলা বারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল। শহর ছাড়িয়ে উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে চড়াই-উৎরাই রাস্তা পেরিয়ে, সুন্দর কালো পিচের হাইওয়ে ধরে বাস ছুটে চলল তীরগতিতে। রাস্তা ভালো থাকায় বাস জার্নির বিশেষ কোনো ধকল সহ্য করতে হয়নি। যদিও স্থানীয় যাত্রী সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায় সেই আরাম কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। ২/২ সিটে তিনজন মিলে চেপে চেপে বসার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা। প্রচণ্ড ভিড়ের চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। বুঝলাম সব রাজ্যেই যানবাহন ব্যবস্থা প্রায় একই রকম। ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস’ মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি আমরা একেবারে পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। মনে হচ্ছে যেন হিমালয়ের ন্যাশনাল হাইওয়ে নম্বর ৫৪ ধরে চলেছি হরিদ্বার থেকে যোশীমঠ। একটু ঠান্ডা হাওয়া প্রাণ জুড়িয়ে দিল, উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে; সহ্যাদ্রি পর্বতমালার মনোরম দৃশ্য বাস জার্নির কষ্ট অনেকটা ভুলিয়ে দিল। মাঝেমাঝেই নজরে পড়ছে বেশ বড় বড় জলাশয়; সেই জলাশয়ের পাড় ঘেঁষে সবুজ পাহাড়ের ঢাল। মহারাষ্ট্রের এই অঞ্চলে আমাদের প্রথম আসা, তাই বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য। পথের দু’ধারে হলুদ ফুলের সারি, রাস্তার ধারে পশু পাখির ছবি আঁকা অভয়ারণ্যের একটা বড় সাইনবোর্ড নজরে পড়ল। তার মানে আমরা ভীমাশংকর অভয়ারণ্যের একবারে সীমানার কাছে এসে পড়েছি। প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা পর আমরা মঞ্চের, গোরেগাঁও, রাজগুরুনগর, প্রভৃতি শহরাঞ্চল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ভীমাশংকর।

প্রথম দর্শনেই ভালোলাগা, বাস থেকে নেমে মনে হলো কোন পার্বত্য গ্রামে এসে পৌঁছেছি। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা। হিমেল বাতাসে একটু শীত-শীত ভাব। কুয়াশার চাদর যেন ধীরে ধীরে নেমে আসছে। এখানকার উচ্চতা প্রায় ৩৫০০ ফিট। বাস স্ট্যান্ডের পাশেই দুর্গা মাতার মন্দির। চারিদিকে পূজার সরঞ্জাম ও বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে দোকানিদের ভিড়। তীর্থ যাত্রীদের ভিড় সেরকম নেই বললেই চলে। সবাই মন্দির দর্শন করে ফিরে যাবেন। আমরা প্রায় ৩০০ সিঁড়ি নেমে পৌঁছে গেলাম মন্দির চত্বরে। মন্দিরের স্থাপত্য নজর কাড়ার মতো, বহু প্রাচীন কালে পাথরের তৈরি মূল গর্ভগৃহের চূড়াটি প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। চূড়ার মাথায় গেরুয়া ধ্বজা লাগানো রয়েছে। গর্ভগৃহের লাগোয়া নাটমন্দির বেশ প্রশস্ত, নাটমন্দিরের দুইপাশে কারুকার্যমন্ডিত পাথরের খিলান। মন্দিরের গায়ে নানা দেবদেবীর মূর্তি, পিছন দিকে মোক্ষ কুণ্ড, প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি ক্ষুদ্র জলাশয়। আর মন্দিরের দক্ষিণ দিকে ভীমা নদীর উৎস।

আমরা একটি ফুলের দোকানে জিজ্ঞাসাবাদ করে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের এক পূজারীর বাড়িতে। তিনি ৭০০ টাকার বিনিময়ে একটি ঘরে আমাদের তিনজনকে থাকতে দিলেন। ঘরটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তবে কমন বাথরুম। স্নান সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মন্দিরের দেবতা দর্শনে। ভীমাশংকর দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। প্রায় সন্ধ্যা হয়-হয়, মন্দিরে ভিড় নেই বললেই চলে। অল্পসংখ্যক তীর্থযাত্রীদের লাইন পেরিয়ে প্রথম দর্শন গর্ভগৃহের দেওয়ালে টাঙানো আয়নার প্রতিফলনে। এখানে এটাই রীতি, বাইরে গোটা চারেক ক্লোজ সার্কিট টিভি আর এল.সি.ডি. স্ক্রীন, সেখানেও ভীমাশংকর’জীর দর্শন পাওয়া যায়। শিবলিঙ্গ রূপার আবরণ দিয়ে পরিবৃত। সন্ধ্যা আরতির আগে যখন স্নান করানো হবে তখন সেই আবরণ উন্মোচন করা হবে, তাই সন্ধ্যারতির অপেক্ষায় আমরা নাটমন্দিরে বসে রইলাম।

নাটমন্দিরের অন্দরমহলের চারিদিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ দৃষ্টি চলে গেল নাটমন্দিরের ছাদের দিকে। তাকিয়ে দেখি হাজার হাজার কত রংবেরঙের প্রজাপতি সারি দিয়ে বসে রয়েছে। কমলা, সবুজ, নীল, হলুদ, বাদামি, গোলাপি, আরো কত রকমের বিচিত্র প্রজাপতির দল। মনে পড়ল পাশেই তো রয়েছে ভীমাশংকর স্যাংচুয়ারি, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির ফ্লোরা এবং ফনার সন্ধান পাওয়া যায়।

ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল, মন্দির চত্বর প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল। গোটা নাটমন্দির এবং গর্ভগৃহ পরিষ্কার করা হলো। আমরা এল.সি.ডি. স্ক্রীনে দেখলাম  – ধীরে ধীরে শিবলিঙ্গের আবরণ উন্মোচন করা হল। আমরা বৃষভরাজ নন্দীকে প্রণাম জানিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলাম। সঙ্গে গুটিকয়েক তীর্থযাত্রী, প্রাণভরে দর্শন করলাম কৃষ্ণবর্ণ জ্যোতির্ময় শিবলিঙ্গ। বেশ বড় গৌরী পট্টর মধ্যে মূল শিবলিঙ্গ। একহাত’এরও কম উঁচু লিঙ্গের মাথায় মাঝখানে সামান্য একটু ফাটলের মত দাগ দেখা যায়, সেইখানে খুব ক্ষীণ ধারায় জল বেরিয়ে আসছে। পুরোহিতমশাই বললেন ওই লিঙ্গের একাংশ মহাদেব এবং অন্য অংশে পার্বতী, আর মাঝে ভীমা নদীর উৎসমুখ। ভীমাশংকরজীর পিছনদিকে দেওয়ালে মা পার্বতীর দন্ডায়মানা সুন্দর মূর্তি। ভীমাশংকরজীকে চিনি, দুধ, দই, মধু ও কর্পূর সহযোগে জল দিয়ে স্নান করানো হলো। স্নানের পর চন্দন এবং ফুলের মালা দিয়ে তাঁকে সাজানো হলো। তখন তাঁর অন্য এক রূপ। আরতির ঠিক আগে আমরা গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এসে দরজার সামনে নন্দী মূর্তির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ভীমাশংকরজীর আরতি দর্শন করতে লাগলাম, তবে সরাসরি নয়-দর্পণ এর মাধ্যমে। এক অচেনা শ্রুতি মধুর সুরে গান গাইতে গাইতে, ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে, তিনজন পুরোহিত শিবের আরতি করতে লাগলেন। নির্জন পরিবেশে আরতির সেই সুরের মূর্ছনা সহ্যাদ্রি পর্বতমালার গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের মনে এক অনির্বচনীয় পবিত্রভাব জাগিয়ে তুলল।

আরতি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মন্দির সংলগ্ন সব দোকান পাট ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করল। আমরা তিনজন তাড়াতাড়ি একটি দোকানে গিয়ে রাতের আহার যখন শেষ করলাম তখন ঘড়িতে রাত আটটা বাজে। এই অঞ্চলে রাত্রিতে আর কেউ বের হয় না। পুরোহিত, সাধু, দোকানি, সবাই শিবের ভোগ আরতি সম্পূর্ণ হয়ে গেলে যে যার নিজেদের বাড়ি বা আশ্রমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন, কারণ এই পাহাড়ি অঞ্চলের অভয়ারণ্যে এখনো বাঘ, ভাল্লুক, বন্য শুয়োর ও নানা রকম বিষধর সাপ ইত্যাদি আছে। বেশি রাত্রে তাদের ডাক শুনতে পাওয়া যায়, এই জঙ্গলে অনেক ধরনের ঔষধি গাছও পাওয়া যায়। রাতের আহারের পর একটু রংবেরঙের মিষ্টি প্যাড়া আস্বাদন করলাম। অপূর্ব তার স্বাদ, বড় বড় লোহার কড়াই’এর গায়ে লেপে দেওয়া আছে। ওজন দরে এই প্যাড়া বিক্রি হয়। ৩০০ সিঁড়ির দুই ধারে দোকান গুলি। ধীরে ধীরে রাস্তাঘাট সব অন্ধকারে ঢেকে গেল; আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মন্দির চত্বরে এসে পৌঁছলাম। ভীমাশংকর গ্রাম এখন নীরন্ধ্র অন্ধকারে নিমজ্জিত, মনে হচ্ছে কোন এক অচিনপুরের নির্জন আকাশতলে আমরা তিনজন এসে পড়েছি। পাহাড়ের উপরের দিক থেকে নাম-না-জানা পশু পাখির ডাক ভেসে আসছে। এই গভীর অন্ধকারে মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সি.এফ.এল. ল্যাম্প এর সাদা আলোর ছটা ধীরে ধীরে কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক মোহময় পরিবেশ রচনা করে চলেছে। কিছুক্ষণ এই নির্জনতাকে উপভোগ করে আমরা লজে ফিরে গেলাম। পরদিন খুব ভোরে মন্দিরে পুজো দেওয়ার প্রোগ্রাম থাকার জন্য তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন মঙ্গল আরতির ঘন্টার শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙলো। খুব ভোরে স্নান সেরে ভীমা কুন্ডে’র জল মাথায় দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। আমাদের লজের মালিক পুরোহিতমশাই, খুব যত্নসহকারে আমাদের পুজো দেওয়ালেন। শিবলিঙ্গের উপর এখন অত্যুজ্জ্বল রুপার আভরণ। আমরা তার উপরেই জল ঢাললাম, ফুল দিয়ে সাজিয়ে আরতি করলাম। তিনি মন্ত্রোচ্চারণ করিয়ে আমাদের পুষ্পাঞ্জলী দেওয়ালেন। জ্যোতির্লিঙ্গের সামনে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। কোন কোলাহল নেই, কোন লাইন নেই, কোন তাড়াহুড়ো নেই, কোন ব্যস্ততা নেই, খুব শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সূর্যোদয়ের আগেই আমরা মনের আনন্দে সেই পূজা-অর্চনা  সম্পন্ন করলাম। তবে শ্রাবণ মাসে এবং মহাশিবরাত্রির সময় খুব ভক্ত সমাগম হয় এবং মেলা বসে। পূজার্চনা শেষে পুরোহিতমশাই আমাদের কপালে ত্রিপুণ্ড্র এঁকে দিলেন। তিনি আমাদের শোনালেন ভীমাশংকর জ্যোতির্লিঙ্গের পৌরাণিক কাহিনী এবং মাহাত্ম্য।

তিনি বলতে শুরু করলেন – পুরাকালে ত্রিপুরাসুর নামে এক দৈত্য এই জঙ্গলে বাস করত। তার হিংস্র স্বভাব ও অত্যাচারে, স্বর্গ-মর্ত-পাতাল এর অধিবাসী দেব ও ঋষিকূল দারুন বিপন্ন হয়। তারা শরণ নেয় ভগবান দেবাদিদেব মহাদেবের। তাদের প্রার্থনায় স্বয়ং ভগবান শংকর এই ত্রিপুরাসুর দৈত্যকে বিনাশ করতে রাজী হন। তিনি ভীমকায় শরীর ধারণ করে তার সামনে উপস্থিত হন, মহাদেবের এই রুদ্র মূর্তি দেখে অসুর ভয় পেলেও তার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়। কয়েকদিনের ভীষন যুদ্ধের পর ত্রিপুরাসুরকে দেবাদিদেব মহাদেব বধ করেন। এই সময় রণ-ক্লান্ত মহাদেব সহ্যাদ্রি পর্বতের উপর, এই ঠান্ডা জায়গায় এসে বিশ্রাম নেন। তাঁর পরিশ্রান্ত ও ঘর্মাক্ত শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরতে থাকে, ক্রমে সেই স্বেদ-ধারা থেকে একটি স্রোতের উৎপত্তি হয় এবং ক্রমে নদীর আকার ধারণ করে। ভীমকায় শঙ্করের দেহ নিঃসৃত বলে এই নদী ভীমা নদী নামে পরিচিত হয়। আজও গভীর জঙ্গলের মধ্যে সেই স্রোতের ধারা দেখা যায়।

অসুর নিধনের পর ভক্তগণ আশুতোষ মহাদেবকে এই বলে অনুরোধ করেন যে, সাধুসন্তদের রক্ষা করার জন্য তিনি যেন কৃপা করে এই ক্ষেত্রে সদাসর্বদা বিরাজ করেন। ভক্তবৎসল ভোলানাথ ভক্তবাঞ্ছা পূরণ করবার জন্য এই সহ্যাদ্রি পর্বতের কোলে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে ভীমাশংকর নামে চিরস্থির হয়ে যান। তাঁর শরীরের স্বেদ আজও ভীমা নদীর ধারা হয়ে নির্গত হয় এই শিবলিঙ্গ থেকে। ভীমাশংকর মহাদেবের পুরাণ কথা শেষ করে পুরোহিত দুই হাত জোড় করে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম জানালেন তাঁর সম্মুখে বিরাজমান ভীমাশংকর জ্যোতির্লিঙ্গকে। আমরাও সাষ্টাঙ্গে মহাদেবকে প্রণাম ও স্পর্শ করে বেরিয়ে গেলাম গর্ভগৃহ থেকে।

উদাত্ত কণ্ঠে পুরোহিত বলে চলেছেন –

ওঁ নামো শম্ভবায় চ ময় ভবায় চ

নমঃ শংকরায় চ ময়স্করায় চ

নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ ওঁ।

তাঁর উচ্চারিত পবিত্র মন্ত্র মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অপূর্ব মোহময় আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করল। পূব আকাশে তখন অরুণোদয় হয়ে গেছে, নীল আকাশ তলে সহ্যাদ্রি পর্বতের ঢালে সবুজ অরণ্য প্রভাত সূর্যের আলোয় এক রঙিন চক্রবাল তৈরি করেছে। নানা রকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে, ভীমাশংকর গ্রাম ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।

ঘরে ফিরে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মন্দিরের আশেপাশে কিছু ছবি তোলার জন্য। মন্দিরের পূর্বদিকে শনি মহারাজের মন্দির, এক বিশাল পিতলের ঘন্টা ঝুলছে এই মন্দিরের সামনে, তার গায়ে লেখা ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে এক পেশোয়া এটা তৈরি করিয়ে ভীমাশংকর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। বর্তমানে এই ঘন্টাটি নাড়ানো বা বাজানো নিষেধ। মূল মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দশাবতারের ছোট ছোট মূর্তি খোদাই করা আছে। মন্দিরের সামনে একটি মহারাষ্ট্রীয় ধাঁচের কালো পাথরের দীপস্তম্ভ। বিশেষ বিশেষ পর্বে এখানে একসঙ্গে অনেক প্রদীপ জ্বালানো হয়। মন্দিরের পশ্চিম গাত্রে পাথরে খোদাই করা মেটে সিঁদুর লাগানো হনুমানজীর মূর্তি। মন্দিরের দক্ষিণ পার্শ্বে ভীমা নদীর উৎস কুণ্ড। ভক্তরা এখানেই স্নান সেরে জল নিয়ে যাচ্ছেন বাবার মাথায় ঢালার জন্য। কুন্ডে’র একধারে একটি ছোট শিবলিঙ্গ, অন্যদিকে শ্রী গণেশের মূর্তি; কুন্ডের জলে অনেক ছোট ছোট মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। মন্দিরের পূর্ব পাশ দিয়ে একটা পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে; সেই সিঁড়ির প্রান্তে একটি মেঠো পথ চলে গেছে গভীর জঙ্গলে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পশ্চিম দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম, দূরে সবুজ পাহাড়ের কোলে ভীমাশংকর গ্রামের ঘরবাড়ি। নীল আকাশ তলে সবুজ সহ্যাদ্রি পর্বতের ঢালে ভীমাশংকর মন্দিরের চূড়া সূর্যের কিরণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, সেই চূড়ায় লাগানো গেরুয়া ধ্বজা মৃদুমন্দ হাওয়াতে পতপত করে উড়ছে, এক আনন্দময় পরিবেশ। বেশ কিছু ছবি তুলে নেমে এলাম মন্দির প্রাঙ্গণে।

এবার ফিরে যাবার পালা, ঘরে ঢুকে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আবার প্রায় ৩০০ পাথরের সিঁড়ির ধাপ পায়ে-পায়ে অতিক্রম করে এলাম বাস স্ট্যান্ডের কাছে। কিছু কিছু মারাঠি ভক্তের আগমন ঘটছে। সিঁড়ির দুই ধারে ফুলের পসরা সাজিয়ে গ্রামের মহিলারা বসেছে। সতেজ রঙিন ফুল আনা হয়েছে কাছেই গ্রাম বা জঙ্গল থেকে। লোহার কড়াইতে রঙিন প্যাড়া, পথের ধারে ভিক্ষুক খঞ্জনি বাজিয়ে মারাঠি সুরে গান গাইছে। সিঁড়ির দুই ধারে পাহাড়ি ঢালে সবুজ জঙ্গল। ৩০০ সিঁড়ির শেষে বাঁদিকে দুর্গা মন্দির। মন্দিরের চূড়া, সামনের পথ নবরাত্রি উপলক্ষে আলো দিয়ে সাজানো। রাতের আলোকসজ্জায় এই মন্দিরের রূপ মনে মনে কল্পনা করলাম। দুর্গা মন্দিরের পূর্বদিকে প্রবেশপথ, প্রথমেই নাট মন্দির। সেই নাটমন্দিরে এক ভক্ত এক ধরনের তারের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে একটি ধূন গাইছেন। তাঁর গানের সুরের মূর্ছনা, সেই বাদ্যযন্ত্রের মিষ্টি আওয়াজ, নাটমন্দিরে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক মনোমুগ্ধকর মায়াজাল সৃষ্টি করে চলেছে। মূল মন্দিরে সিংহবাহিনী বিরাজমানা আছেন, তাঁকে প্রদক্ষিণ ও প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। যেতে হবে আরো অনেক দূর, তবু ইচ্ছে করেনা ভীমাশংকর ছেড়ে চলে যেতে। বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেই আমাদের পুনা যাওয়ার বাস চলে এলো। পুনা থেকে ট্রেনে করে পূর্ণ, সেখান থেকে হিঙ্গলি স্টেশন হয়ে চলে যাব আর এক মহারাষ্ট্রের তীর্থক্ষেত্র ওন্দানাগনাথ।

প্রায় এক দশক আগের ভ্রমণকাহিনী আজ লিখতে বসে ভাবি যে সেই সময় গুরুদেবের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি বা ঈশ্বরের কৃপায় ক্রিয়াযোগের কোন পদ্ধতি আমি প্রাপ্ত হইনি। যদি পেতাম তাহলে এই ভীমাশংকর ভ্রমণে আরও এক নতুন মাত্রা যোগ হত। সহ্যাদ্রি পর্বতের সবুজে ঘেরা সেই পাহাড়ের পাদদেশে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে, দেব দেউলের এক নির্জন স্থানে বসে, অবশ্যই গুরু পরম্পরা প্রাপ্ত এই দুর্লভ ক্রিয়াযোগ পদ্ধতি অনুশীলন করতাম। প্রাণকে নিয়ে মূলাধার থেকে আজ্ঞা চক্র হয়ে হয়তো তাঁর কৃপায় পৌঁছে যেতাম সহস্রারে, যেখানে পৌঁছে হয়তো সমাধিস্থ হয়ে যেতাম। দেব দুর্লভ দর্শন, রোমাঞ্চকর অনুভূতি ও অভূতপূর্ব উপলব্ধি নিয়ে আবার ফিরে আসতাম এই ধরাধামে। না ফিরতে পারলেও কিছু এসে যেত না, চিরতরে লীন হয়ে যেতাম দেবাদিদেবের চরণে। সত্যিই দেবভূমি ভীমাশংকর সাধন ভজনের এক অতি আদর্শ স্থান। এখানকার শুদ্ধ পরিবেশ অন্নময় কোষ থেকে আনন্দময় কোষে উত্তরণের এক অসীম শক্তির উৎস। সেখানকার স্থান মাহাত্ম্য সাধারণ মন ও বুদ্ধির অগোচর। এই জীবনে জানিনা আবার কবে যাওয়া হবে বা আদৌ হবে কিনা, কিন্তু মানস ভ্রমণ অবশ্যই সম্ভব। আর গুরুদেবের কৃপায় যদি কোনও দিন সূক্ষ্ম শরীরে ভ্রমণ করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারি, তাহলে পুনঃ পুনঃ দর্শনে এই মানব জীবন ধন্য করব, এই আমার অভিলাষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Fresh news and analysis on NDA News USA. Click the link!